একাকী মৃত্যু

একাকী মৃত্যু


বেশিদিন আগের কথা নয়। একটি রিপোর্টে জানানো হয় – এক ব্যক্তি পর্ন ম্যাগাজিনের বিশাল স্তূপের নিচে চাপা পড়ে মারা যায়।

শুনতে অদ্ভুত লাগার কথা। তবে আসল ঘটনা ঠিক এমন নয়। লোকটি জাপানের একটি এপার্টমেন্টে মারা যায়। মৃত্যুর এক মাস পর তার লাশ উদ্ধার করা হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল পঞ্চাশ বছর। ঘটনাস্থলে তার সাথে ছিল একগাদা পর্নের কালেকশন। জাপানের একটি নিউজ ম্যাগাজিনের (Nikken Spa) তথ্যানুসারে লোকটি হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়।

যদিও কিছু রিপোর্টে ভুয়া খবর আসে, তবে প্রকৃত ঘটনা আসলেই মর্মান্তিক। পর্ন ম্যাগাজিনের মজুতদার ঐ ব্যক্তি একা সেগুলোর মাঝে মারা যায়। জীবনের শেষ মুহূর্তগুলোতে সময় দেওয়ার মতো কেউ তার পাশে ছিল না। তার কথাও মনে পড়েনি কারও, শুধু বাড়িওয়ালা বাদে। বাসার ভাড়া দিতে দেরি হওয়ায় সে তাকে খুঁজছিল। খুবই বেদনাদায়ক, তাই না?

পর্নোগ্রাফি একজন মানুষকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। জাপানসহ পৃথিবীতে একাকী মৃত্যুবরণকারী লোকের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর পেছনে কারণ কী? আর পর্নোগ্রাফিই বা এসবের সাথে কীভাবে জড়িত? আসুন, জানা যাক।

একাকীত্ব
বিগত কয়েক দশকে জাপানে বিভিন্ন সামাজিক কারণে একাকী মৃত্যুর ঘটনা অনেক বেড়ে গেছে। মানুষ পরিবারকে গুরুত্ব দিচ্ছেনা। এছাড়াও পর্নোগ্রাফির সাময়িক আনন্দ সম্পর্কগুলোকে আরও ভঙ্গুর করে দিচ্ছে। টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি পরিবহন কোম্পানির মালিকের দেয়া ইন্টারভিউ হতে জানা যায়, এরকম মৃত্যুর ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। তার কোম্পানি এমন অনেক লাশ পরিবহন করেছে। অনেকের লাশ তো মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ বা মাস খানেক পরেও পাওয়া যায়। তিনি বলেন, “একাকী মৃত্যুবরণকারী বেশির ভাগ লোকই ছন্নছাড়া জীবনযাপন করে। তারা খুব বেখেয়ালি আর দায়িত্বহীন থাকে। কোনো সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয় না। তাই তারা সহজেই সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।”

শুধু বৃদ্ধরা নয় জাপানে তরুণরাও একইভাবে নিঃসঙ্গতায় ভুগছে। ২০১৬ সালে প্রকাশিত এক সরকারি জরিপ অনুযায়ী জাপানে ৪২ শতাংশ পুরুষ ও ৪৪.২ শতাংশ নারী অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক অবিবাহিত। এদের বয়স ১৮-৩৪। অন্য কিছু হিসাব অনুযায়ী ৮৫.৭ শতাংশ পুরুষ ও ৮৯.৩ শতাংশ নারী বিয়ের ব্যাপারে উদাসীন।

সিএনএন এর এক রিপোর্ট অনুযায়ী বাস্তবতার ওপর ফ্যান্টাসিকে প্রাধান্য দেওয়ার মানসিকতা থেকে জাপানের মানুষদের মাঝে সম্পর্ক ছিন্ন হবার মতো অবস্থা বিরাজ করছে। জাপানে পর্নোগ্রাফির ব্যাপকতা অনেক বেশি। সেখানে অ্যানিমেটেড পর্ন খুবই সহজলভ্য। এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, জাপানের পর্ন ইন্ডাস্ট্রি তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য বিভিন্ন ধরণের পর্ন নিয়ে আসছে। এতে নিঃসঙ্গদের নিঃসঙ্গতা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে।

পারিবারিক সম্পর্ক
একাকী আপনজনহীন মৃত্যুর ব্যাপারটা হঠাৎ স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্তদের মাঝে। কর্মজীবন শেষে তারা সবকিছুতেই কেমন যেন বিতৃষ্ণা অনুভব করে। একইসাথে তাদের আত্মসম্মানবোধও কমে যায়। তারা নির্জনে একটা নিঃসঙ্গ জীবন গড়ে তোলে। যেখানে প্রিয়জনের অভাব পূরণ করতে নিঃসঙ্গতার তাদের সঙ্গী হয় পর্নোগ্রাফি।

রিসার্চ বলে পর্নোগ্রাফি আর ভার্চুয়াল ফ্যান্টাসিতে বেশি মত্ত থাকার ফলে একজন ব্যক্তি বাস্তব জীবনের ভালোবাসা, এমনকি যৌনমিলনেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। তাই অনেক পর্ন আসক্তদের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তারা বাস্তবে যৌনমিলনে তেমন আনন্দ পায় না; বন্ধুত্ব, ভালোবাসা তাদের কাছে অর্থহীন মনে হয়। ফলে তারা নিঃসঙ্গতার জালে আটকে যায়।

বিশ্বব্যাপি এই সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। জাপানের ঐ পর্ন সরবরাহকারী নিঃসঙ্গ লোকটির ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটাই ঘটেছে। টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি খবরে বলা হয় – টোকিও শহরে একদল প্রতিবেশী ‘একাকী মৃত্যু’ হতে সচেতনতা বাড়াতে এলাকাবাসীর মাঝে প্রচারণা চালায়। তারা বিভিন্ন ইভেন্টের আয়োজন করছে। সেখানে নিউজলেটার বিতরণ করা হয় এবং যারা একা থাকেন তাদেরকে সামাজিক জীবনযাপন করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। এই ধরণের প্রচারণায় পর্নোগ্রাফির ব্যাপারটাও তুলে ধরা উচিত।

পর্নকে ট্যাবু বানিয়ে রাখা
পর্ন ম্যাগাজিনের মদতদাতা লোকটির বাসা পরিষ্কার করেছিলেন এমন এক ব্যক্তির সাক্ষাতকার নিয়েছিল Nikkan Spa। সে বলেছিল, “আমরা তার বাসা থেকে পর্নের সাথে সম্পর্কিত সব জিনিস সরিয়ে ফেলি, যাতে তার আত্মীয়রা না জানতে পারে।” চিন্তা করুন, একাকীত্বের সাথে যখন পর্নের ইফেক্ট নিয়ে কথা বলাটাও ট্যাবু হয়ে দাঁড়ায় তখন একাকী মৃত্যুর মতো মর্মান্তিক ঘটনা ছাড়া আর কী আশা করা যেতে পারে।

আমরা সবাই একটি সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবন চাই। চাই ভালোবাসা ও সুসম্পর্কের মাঝে বাঁচতে। পর্নোগ্রাফি নামক যে দানবের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ করছি, তা আজ জাপানের বিচ্ছিন্ন সমাজ ব্যবস্থার জন্য দায়ী। এটি স্বাভাবিক সম্পর্কগুলোর ধারণাকে বিকৃত করে দেয়। বিচ্ছিন্নতা আর উগ্রতার সংস্কৃতি লালন করে। অথচ আমরা চাই না প্রিয়জনদের জায়গায় প্রযুক্তিকে স্থান দিতে। আর তাই পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়াটা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।

আমরা এমন একটি সমাজকে মেনে নিতে পারিনা যেখানে বৈষম্য, বিচ্ছিন্নতা ও উগ্রতা বিরাজ করে। কারণ, ভালোবাসা অনেক দামি কিছু। কেউই ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হতে চায় না।
.
অনুবাদ: #teamFAD