মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নতুন প্রযুক্তি ও পর্নোগ্রাফির প্রভাব

মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নতুন প্রযুক্তি ও পর্নোগ্রাফির প্রভাব


পর্নোগ্রাফি আসক্তিতে ভোগা প্রতিটি মানুষই জানে, এটা মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর কতোটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যতই দিন যাচ্ছে নতুন নতুন প্রযুক্তি আসছে। ইন্টারনেট সহজলভ্য হচ্ছে। ফলে পর্নোগ্রাফি আসক্তদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে আজ হুমকির সম্মুখীন।

এই আর্টিকেলে আমরা সেই প্রযুক্তিগুলো এবং আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর পর্নোগ্রাফির প্রভাব সম্পর্কে জানব। পরিশেষে আমরা এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের উপায় সম্পর্কেও অবগত হব।

পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা:

আমরা সকলেই জানি, স্মার্টফোন, ট্যাবলেট ও অন্যান্য বহনযোগ্য ডিভাইসে ইন্টারনেট কানেকশন অনেক সহজলভ্য হয়ে গেছে। যার ফলে পর্নোগ্রাফি আসক্তির হার বৃদ্ধি পাচ্ছে।

হাতে যখন এমন একটি ডিভাইস থাকে যা যেকোনো মুহূর্তে ব্যবহার করা যায়, তখন অশ্লীলতা থেকে নিজেকে দূরে রাখা আসলেই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ডিভাইসগুলো এতই ছোট যে আপনি কী দেখছেন তা কেউ কাছে না আসলে দেখতে পায় না। আবার কেউ কাছে আসতে নিলেও সহজেই লুকিয়ে ফেলা যায়। তাই এসব ডিভাইস ব্যবহার করা অবস্থায় পর্ন দেখার প্রবণতা বেশি থাকে।

গবেষণায় জানা যায়, পৃথিবীতে যত ধরণের ওয়েবসাইট আছে তার ১২ শতাংশ পর্নোগ্রাফিক। এর মধ্যে প্রায় সব ওয়েবসাইটই সেল্ফ রিপোর্টিং এইজ ভেরিফিকেশন প্রসেসের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এই এইজ ভেরিফিকেশনে কোনো লাভই হচ্ছে না। কারণ, ব্যক্তির বয়স ১০ হোক আর ৫০ হোক সে নিজেকে প্রাপ্তবয়স্ক দাবী করে অনায়াসেই ঢুকে পড়ে পর্নসাইটে। 

অন্যান্য নেশাকর দ্রব্যের ক্ষেত্রে যেমন আসক্ত ব্যক্তি বয়সে যত ছোট হয়, তার আসক্তি তত বেশি গভীর হয়, পর্নের ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটাই ঘটে। অর্থাৎ, কারও বয়স কম হলে, তার জন্য পর্ন আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসাটা বেশ কঠিন।

পর্ন দেখার কারণে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ব্যপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আসক্তি ব্যক্তির মধ্যে বিষণ্ণতা (depression), দুশ্চিন্তা (anxiety) দেখা দেয়। ব্যক্তিগত সম্পর্কের অবনতি হয়। স্ত্রীর সাথে শারীরিক সম্পর্কে অক্ষমতা দেয়। এই সবকিছু মিলে তার জীবনতাই দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। মন ভালো না থাকায়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সে ব্যর্থ হতে থাকে।  

ওয়েবক্যাম

এটা অনেকটাই বাস্তবতার মত। আপনি অন্য একজনের সাথে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যুক্ত হবেন। সে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে আপনাকে উত্তেজিত করে তুলবে। আপনি বলতে পারেন যে এটা তো কোনো ক্ষতিকর বিষয় না। কারণ, এখানে সত্যিকার অর্থে কোনো শারীরিক সম্পর্ক হচ্ছে না। শুধু চোখের দেখাদেখি, এই তো।

এই ওয়েবক্যাম সেক্স বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কিন্তু ফ্রি না। তারা বিভিন্ন একাউন্টগুলো থেকে আর্থিকভাবে ঠিকই লাভবান হয়। কামনার বশীভূত হয়ে অনেক যুবকেরাই তাদের পাতা ফাঁদে পা বাড়ায়। অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে ওয়েবক্যাম সেক্স করা যুবকদের অনেকেই বিষণ্ণতায় ভোগে। পর্নের মতো এখানেও তাদের সেক্সচুয়াল ওরিয়েন্টেশনে পরিবর্তন আসে। ফলে স্ক্রিনে মেয়ে দেখে সে যতোটা উত্তেজনা অনুভব করে নিজের স্ত্রীর ক্ষেত্রে তেমনটা করে না। এটা এমন এক সমস্যা যা ডিভোর্সের রূপ নিতে পারে। এ ছাড়াও দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন কাজে তাদের মনোযোগ হ্রাস পায়।

এ সবকিছুর পাশাপাশি আরও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, সম্প্রতি কিছু নিউজ রিপোর্টে জানা যায়, ওয়েবক্যামে বেশকিছু সংখ্যক নারীদের পাচার করে এ ব্যবসায় নিযুক্ত করা হয়েছে। আপনি যদি ওয়েবক্যামের এ ফাঁদে পড়ে থাকেন তাহলে জেনে রাখুন, আপনি নিজের অজান্তেই একটা অবৈধ ও অমানবিক ইন্ডাস্ট্রিকে সমর্থন করছেন।

ভার্চুয়াল রিয়ালিটি 

একটা গ্লাস বা হেডসেট যা চোখে পরার পর আশেপাশের সবকিছু কাল্পনিক জগতের মতো দেখায়। এটাই ভার্চুয়াল রিয়ালিটি। এই জগতেও পর্নের অনুপ্রবেশ ঘটতে খুব একটা সময় লাগেনি। ওয়েবক্যামের মতো এখানেও রোল প্লেয়িং গেমস খেলা যায়। এই গেইমে একা একজন স্বাধীন খেলোয়ার হিসেবে খেলা যায়। আবার চাইলে অন্যদের সাথেও মিলিত হওয়া যায়।

কিছু গেইম খেলোয়ারদের যৌন মিলনের ব্যবস্থা করে দেয়। অনেক পর্ন আসক্তরা এই গেইমগুলোকেও পর্নের মতোই স্বাভাবিকভাবে নেয়। তাদের মনে একটা ধারণা জন্মে যায়, “এই সম্পর্কগুলো তো বাস্তব নয়”।

অন্যান্য ডিভাইসের মতো ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে পর্নোগ্রাফি ব্যবহারেও একই ধরণের ঝুঁকি থাকে। অর্থাৎ, এটাও বেশ আসক্তিকর। এতে আসক্তরা নিজেদের স্ত্রীর সাথে যৌন মিলনের সময় আরও বেশি সমস্যার সম্মুখীন হয়।

ভার্চুয়াল রিয়েলিটি এমনভাবে প্রোগ্রাম করা হয়েছে যা আমাদের মস্তিষ্কে খুব সহজেই প্রভাব বিস্তার করে। তাই উদ্বেগের বিষয় এই যে- এর মাধ্যমে পর্নোগ্রাফির ব্যবহার আপনার ব্যক্তিগত সম্পর্কের অবনতি ঘটাবেই।

চ্যাটরুম

নতুন প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে অনলাইনের বিভিন্ন সাপোর্ট কমিউনিটি বা গ্রুপগুলো পর্ন আসক্তদের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ। কারণ, তারা প্রতিনিয়ত আসক্তদের প্ররোচনা দিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে এ ধরণের গ্রুপে যুক্ত থাকা মানুষেরা আসক্ত অবস্থায়ও নিজেদের সুস্থ মনে করে।

এই কমিউনিটিগুলোর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হচ্ছে, তারা পর্ন দেখতে উৎসাহিত করে। আসক্তদের কাছে পর্নকে স্বাভাবিক করে তোলে। পর্ন আসক্তদের মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকা অস্বাস্থ্যকর সব চিন্তাকে সমর্থন দেওয়াই যেন তাদের কাজ। এদের কারণে পর্ন আসক্তিতে ভোগা তরুণদের এ আসক্তি থেকে মুক্ত করা আরও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইন্টারনেটের বিভিন্ন দিক আজ মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে পর্নোগ্রাফি অন্যতম। বর্তমানে দ্রুতগতির ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফি এবং একে ঘিরে তৈরি হওয়া বিভিন্ন গ্রুপগুলো আসক্তদের উত্তেজিত করার পাশাপাশি তাদের আজীবন আসক্ত থাকার ব্যবস্থাও করে দিচ্ছে।

মানসিক স্বাস্থ্য

মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর পর্নোগ্রাফির প্রভাব নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। এর মধ্যে একটি গবেষণায় জানা যায়, যৌন উত্তেজক কিছু দেখার পর যারা পর্ন আসক্ত এবং যারা পর্ন আসক্ত না তাদের মধ্যে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।

যখন কোনো পর্ন-আসক্ত ব্যক্তি যৌন উত্তেজক কিছু দেখে তখন তাদের মস্তিষ্কে ডোপামিন নিঃসৃত হয়। এই নিউরোট্রান্সমিটারটি মস্তিষ্কে ইউফোরিয়া উৎপাদনে ভূমিকা পালন করে। সাধারণত যৌন উত্তেজনায় যে পরিমাণ ডোপামিন নিঃসৃত হয়, পর্ন আসক্তদের মস্তিষ্কে তারচেয়েও বেশি ডোপামিন নিঃসৃত হয়।

এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবে দেখা যায়, একজন পর্ন আসক্ত ব্যক্তি স্বাভাবিক যৌন ক্রিয়ার চেয়ে পর্ন দেখাটাকে বেশি প্রাধান্য দেয়। কারণ, তারা পর্নেই বেশি উত্তেজনা অনুভব করে। ফলে একসময় তাদের ওপর হতাশা ভর করে। অন্তরে  অপরাধবোধ জাগে। যৌন উত্তেজক কিছু দেখলেই তারা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে তারা আরও আসক্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে।

যারা পর্নোগ্রাফি আসক্তির সাথে লড়াই করছেন এবং পর্নোগ্রাফি মুক্ত ইন্টারনেট ব্যবহার করতে চান তাদের জন্য কিছু টিপস:

  • এমন ব্রাউজার ব্যবহার করুন যেখানে সার্চ রেজাল্টে পর্নোগ্রাফিক সাইট ফিল্টার করে। যেমন: স্পিন ব্রাউজার।
  • যেসব চ্যাটরুম বা স্প্যাম সাইট বারবার পর্নোগ্রাফিক জিনিস পপ-আপ করে সেগুলো এড়িয়ে চলুন।
  • ব্রাউজার যেন অনাকাঙ্ক্ষিত পপ-আপ না দেখায় সেজন্য পপ-আপ ব্লকার ব্যবহার করুন।
  • যখন ইমেজ সার্চ করবেন তখন ‘সেইফ সার্চ’ অপশন চালু রাখুন।
  • ওয়েবক্যাম, ফোরাম এবং অন্যান্য মাধ্যমগুলো যেখানে পর্নোগ্রাফিক কিছু দেখার সম্ভাবনা রয়েছে সেগুলো থেকে দূরে থাকুন।