দুঃখ-কষ্ট কীভাবে কল্যাণকর হতে পারে?

দুঃখ-কষ্ট কীভাবে কল্যাণকর হতে পারে?


ইবনে তাইমিয়া (১২৬৩-১৩২৮) (রহ.)-এর একটি কালজয়ী শিক্ষা, “কষ্টকে বরকত হিসেবে দেখলে এর সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাবে।” এ ছাড়াও তিনি বলেছিলেন, "আমার শত্রুরা আমার কী করতে পারে? আমার জান্নাত আমার হৃদয়ে রয়েছে। আমি যেখানেই যাই, তা আমার সাথে থাকে। আমাকে কখনো ছেড়ে যায় না। যদি আমাকে কারাবন্দী করা হয়, এটি হবে ইতিকাফ (ইবাদতের জন্য নির্জনতা)। যদি আমাকে হত্যা করা হয়, এটি হবে শহীদী। যদি আমাকে নির্বাসিত করা হয়, এটি হবে হিযরত (আল্লাহর রাস্তায় এক পর্যটকের মতো ভ্রমণ)।” [১]

আমি বহু বছর ধরে এই কথাগুলো আমার মধ্যে ধারণ করে রেখেছি। কথাগুলো আমাদের এই পার্থিব জীবনের বাস্তবতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আমাদের শেখায়, জীবনে যতোই দুঃখ-কষ্ট থাকুক না কেন, এর মধ্যেও কল্যাণ ও আল্লাহর রহমত লুকিয়ে রয়েছে।


জীবনের পরীক্ষাগুলোকে নেয়ামত হিসেবে দেখা

(কারাবাস, হত্যা, নির্বাসন) যে ঘটনাগুলোকে অধিকাংশ মানুষ দুর্দশা হিসেবে দেখে, শায়খ সেগুলোকে আল্লাহর নৈকট্য লাভের বিশেষ সুযোগ হিসেবে দেখতেন। তার হৃদয়ের জান্নাত ছিল ঈমান, জ্ঞান ও ইয়াকিন (বিশ্বাসে দৃঢ়তা)। এই তিনটি উপাদান তাকে সব অবস্থায় (ইসলামের ওপর) অবিচল রেখেছিল। তিনি যে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন তা ছিল সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান, আল্লাহ, কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান। তার হৃদয় আল্লাহর যে বরকতময় বাণীতে পরিপূর্ণ ছিল, সেটা তার শত্রুরা কখনও মুছে দিতে পারেনি।


অন্তরকে প্রভাবিত করতে না পারা

ইবনে তাইমিয়া রহ. তাঁর জীবনে বহু কষ্ট সহ্য করেছেন। একাধিকবার কারাবাস করেছেন। কিন্তু কখনোই চারপাশের পরিস্থিতি দ্বারা তার হৃদয়কে প্রভাবিত হতে দেননি। যেন তিনি এক অভ্যন্তরীণ দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন তাঁর হৃদয়ে। তার শত্রুরা এ দুর্গ ধ্বংস করতে পারেনি! তার হৃদয় পার্থিব শৃঙ্খল ও তার মায়া থেকে মুক্ত ছিল। যেমনি একজন ডাক্তার তার রোগীকে বড় অস্ত্রোপচারের জন্য প্রস্তুত করেন, তেমনি একজন মানুষকেও এই জীবনের পরীক্ষাগুলি সহ্য করার জন্য তার আত্মাকে প্রস্তুত করতে হয়।

আমার একজন শিক্ষক বলেছিলেন, "যদি হৃদয় বিশুদ্ধ ও সুস্থ থাকে, তাহলে তা যেকোনো কষ্ট সহ্য করতে পারে এবং ভালোভাবে কাজ চালিয়ে যেতে পারে।" [২]

এই অবস্থায়, ব্যক্তির নৈতিকতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে। অর্থাৎ তাকওয়া, ধৈর্য, দৃঢ়তা, কৃতজ্ঞতা, বিনয়, সত্যবাদিতা, ন্যায়বিচার, আল্লাহর প্রতি আস্থা, কদর আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টি, ক্ষমাশীলতা ও দয়া, এবং অন্যদের সহায়তা করার গুণ লাভ করতে পারে। ইবনে তাইমিয়ার হৃদয় তার জীবনের পরীক্ষার মুহূর্তগুলো দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করতে প্রস্তুত ছিল। এর অর্থ এই নয় যে, তিনি শারীরিক ও মানসিক কষ্ট অনুভব করেননি; তিনি কষ্ট পেয়েছিলেন, তবে কখনও তার মিশন থেকে পিচপা হননি। নীতির প্রশ্নে সর্বদা অবিচল ছিলেন।

আমরা অন্তরে যা ধারণ করব

আমরা আমাদের হৃদয়ে যা ধারণ করি, তা আমাদের আচরণ, ভাষা ও কাজে প্রকাশ পায়। হৃদয় একটি পাত্রের মতো, আরব প্রবাদে বলা হয়, "প্রত্যেক পাত্র থেকে তার ভেতরের জিনিসই ঝরে।” [৩] যখন আয়েশা (রা.) রাসূল (ﷺ) চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হন, তিনি উত্তর দেন, "নিশ্চয়ই, আল্লাহর রাসুলের চরিত্র ছিল কুরআন।" [৪] কুরআন তার হৃদয়ে অবতীর্ণ হয়েছিল। তার কাজ ও চরিত্র এই ঐশী বাণীর প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছিল।


ফিলিস্তিনিরা জীবন ও সত্যের বীজ বপন করে; ইসরায়েল মিথ্যা ও বোমা বপন করে 

যখন আমি ফিলিস্তিনে আমার ভাই-বোনদের ভিডিও দেখি, তখন আমি কুরআনের প্রতিচ্ছবি দেখি। একটি শিশু রুটি বানাচ্ছে আর কুরআন তিলাওয়াত করছে। আরেক শিশু ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বসে কুরআন পড়ছে। একজন বৃদ্ধ ভাই নিজের ঘরের ধ্বংসাবশেষে আটকে থেকে ফজরের নামাজ পড়ছেন। বোনেরা একত্রিত হয়ে কুরআন মুখস্থ করছেন। এমনকি যখন অ্যানেসথেশিয়া ছাড়াই অঙ্গ কেটে ফেলা হচ্ছে তখনও শিশুরা কুরআন পড়ছে। ভাইয়েরা আল্লাহর কাছে সাহায্যের প্রার্থনা করছেন আর ধ্বংসস্তূপের মধ্যে পরিবারের সদস্যদের খুঁজছেন। সাংবাদিক ও ডাক্তাররা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন। ধ্বংসাবশেষ থেকে বিড়াল ও কুকুর উদ্ধার করে সেগুলিকে শান্তনা দেওয়া হচ্ছে। বোনেরা সবসময়ই তাদের নামাজের পোশাক পরে থাকেন, যেন বেপর্দা অবস্থায় মৃত্যু না হয়। সবাই কষ্টের মধ্যেও বারবার “আলহামদুলিল্লাহ” বলছেন। ফিলিস্তিনিরা জীবন ও সত্যের বীজ বুনছে, যদিও চারপাশ ধ্বংসে পূর্ণ, আর ইসরায়েলি দখলদারেরা মিথ্যা ও বোমা রোপণ করছে। 


যারা সত্যের পথে থাকে তাদের সর্বদাই চিহ্নিত করা হয় 

ইবনে তাইমিয়া কখনো আশা করেননি যে তিনি শান্তিপূর্ণভাবে অবসর নেবেন; তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সংগ্রাম করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। যারা জ্ঞান অর্জন করে এবং সত্যের পথে থাকে, তারা জানে যে অন্যরা তাদের ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। এ ধরনের মানুষ প্রায়ই অত্যাচার ও দুর্দশার শিকার হয়।

রাসূল (ﷺ) প্রথম ওহি লাভের পর, তার স্ত্রী খাদিজা (রা.) তাকে তার চাচাতো ভাই ওয়ারাাকা ইবনে নাওফালের কাছে নিয়ে যান, যিনি ইনজিলের বিশেষজ্ঞ ছিলেন।
ওয়ারাাকা (রা.) রাসূল ﷺ-কে সতর্ক করেছিলেন যে, তার লোকেরা তাকে তার দেশ থেকে বের করে দেবে, কারণ, "যে-ই সত্য নিয়ে এসেছে, তাকে সর্বদা শত্রুদের মুখোমুখি হতে হয়েছে। যদি আমি সেদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকি, তবে আমি তোমাকে সহায়তা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।" [৫]

ফিলিস্তিনিরা চায় বিজয় অথবা শহীদী মৃত্যু অথবা উভয়ই 

আবু মূসা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) জানিয়েছেন যে রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, "যে তার দুনিয়ার জীবনকে ভালোবাসে, সে তার পরকালে কষ্ট পাবে; আর যে তার পরকালকে ভালোবাসে, সে দুনিয়াতে কষ্ট পাবে। অতএব, ক্ষণস্থায়ী জীবনের ওপর চিরস্থায়ী জীবনকে প্রাধান্য দাও।" [৬]


আবু শুজা, একজন প্রতিরোধ যোদ্ধা যাকে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী হত্যা করেছে। গাজার মানুষদের নিয়ে তার শেষ কথা ছিল, 
"গাজার মানুষ যে ধৈর্য ও সহ্যশক্তি দেখাচ্ছে, তা নবীদেরই দেখানো গুণাবলি। ধৈর্য, স্থিতিস্থাপকতা, মনোবল – এগুলো আমরা গাজার মানুষ ও তাদের যোদ্ধাদের কাছ থেকেই শিখি।” [৭]
আমাদের ফিলিস্তিনি ভাই-বোনেরা তাদের সংগ্রামকে হয় বিজয়, না হয় শহীদী মৃত্যু হিসেবে দেখেন। তাদের চোখ ধ্বংস ও মৃত্যু দেখে, তাদের দেহ আহত ও রক্তাক্ত, কিন্তু তাদের হৃদয় আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় চিরন্তন শান্তি ও সুখের স্বপ্নে জীবন্ত। এটাই সত্য বিজয়, যা ইসরায়েলি দখলদাররা কখনও কেড়ে নিতে পারবে না। কোনো অস্ত্র তাদের বিশ্বাসকে ধ্বংস করতে পারে না।

লেখক: হেদিহ আনসারি-শিরাজি

অনুবাদ ও সম্পাদনা: মো: সাদেক হোসেন মিনহাজ


রেফারেন্স:
[১]আল-ওয়াবিল আল-সায়্যিব ইবন কায়্যিম আল-জাওযিয়াহ
[২] লেকচার “Deeds of the Heart”, উস্তাদা মুজন ওমর, নভেম্বর ২০২৩
[৩] একটি আরবি প্রবাদ
[৪] সহিহ মুসলিম: ৭৪৬, <https://sunnah.com/muslim:746a>
[৫] সহিহ বুখারি: ৩, <https://sunnah.com/bukhari:3>
[৬] সহিহ ইবন হিব্বান: ৭০৯
[৭] https://youtu.be/oyXLhykt8r8