পাপ নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি

পাপ নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি


রাহিদ অনেকদিন ধরে একটা গোপন পাপ থেকে দূরে আছে। ভালোভাবেই কাটছে তার দিন। কিন্তু সেই পাপ না করলেও, তার আমল আগের মতো নেই। শেষ কবে যে সে দীর্ঘ সিজদা দিয়েছিল তার মনে নেই। অথচ আগে সে প্রায়ই দীর্ঘ সিজদায় পড়ে থাকত। আল্লাহর কাছে দুআ করে কাঁদত। কান্নায় ভিজে যেত তার দাড়ি। কাউকে বুঝতে দিত না। মসজিদের এক কোনে বসে মাথা নিচু করে নিঃশব্দে কাঁদত।


আল্লাহর কাছে নিজের অপরাধ, অপারকতা, দুর্বলতা, অসহায়ত্ব প্রকাশ করে কাঁদার যে কি অনুভূতি, সেটা যে এভাবে কাঁদে সে-ই বোঝে। অন্তরের সব কালিমা যেন নিমিষেই মুছে যায়। মন হালকা হয়ে যায়৷ সব হতাশা চলে যায়। কিন্তু এখন রাহিদ চাইলেও কাঁদতে পারে না। তার অন্তর কঠিন হয়ে গেছে। সারাক্ষণ স্ত্রী আর বাচ্চার চিন্তায় পার হয় দিন। কি করলে আরও বেশি উপার্জন করতে পারবে, এ চিন্তায় রাতে ঘুম হয় না তার।


এমনই এক নির্ঘুম রাতে সে একা শুয়ে আছে। আজ তার স্ত্রী পাশে নেই। বাচ্চাকে নিয়ে বাবার বাড়ি গেছে। ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে একটা যৌ`ন উত্তেজনা জাগানোর মতো ঘটনা পড়ে ফেলল। ঘটনাটা তার পুরো মনোজগৎ ওলট-পালট করে দিল। তার এখন আরেকটু উত্তেজনা জাগানোর মতো কিছু দেখতে ইচ্ছে করছে। অথচ একটু আগেও তার মাথায় এ ধরণের কোনো চিন্তাই ছিল না। আগামীকাল সকাল সকাল অফিসে যেতে হবে। দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তে হবে। এটাই ছিল তার পরিকল্পনা।


দেখতে দেখতে রাত ৩টা ৩০ বেজে গেল। কয়েক ঘন্টা সে অশ্লীল ভিডিও দেখে পার করে দিয়েছে। গোসলও ফরজ হয়ে গেছে। ফজরের নামাযের আর মাত্র ২ ঘন্টা বাকি। এ সময় ঘুমাতে না পারলে সারাদিন মাথাব্যথা আর ঝিমুনি ভাব নিয়ে কাজ করতে হবে, এ চিন্তা করতেই তার মন-মেজাজ আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। “কেন আবার এমন করলাম। কেন? কি সমস্যা ছিল আমার? আমি তো বিছানায় শুয়েই ঘুমানোর চেষ্টা করতে পারতাম৷ ঘুম চলে আসত। ফোন কেন ধরলাম। ধ্যাত!” একটার পর একটা চিন্তা তার মাথায় আসছে৷


“ফজরের নামাযের আগে আবার গোসল করতে হবে৷ তাহলে ঘুমবোই বা কতক্ষণ। আজ মনে হয় আর ফজর পড়া হবে না।” এই ভাবতে ভাবতে সে ঘুমানোর চেষ্টা করতে থাকল। হালকা চোখ জুড়িয়ে এলো। কিছুক্ষণ পরই আযানের শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল। আর ঘুম আসছে না। এবার সে উঠে গিয়ে দাঁত ব্রাশ করে গোসল শুরু করল৷ গায়ে পানি ঢালতেই তার কান্না চলে আসল৷ একটু আগেও সে আল্লাহর নাফরমানি করেছে৷ ভাবছে, এতো গুনাহের পরও আল্লাহ তাকে নামাযের জন্য উঠিয়েছেন। গোসলে পর্যন্ত নিয়ে আসলেন। তাঁর দয়া ছাড়া কি এটা সম্ভব? গোসল করার সময়ও মনে হচ্ছিল, আজ বোধহয় মসজিদে যাওয়া হবে না।


বাথরুম থেকে বের হয়ে ফোনে সময় দেখল, জামাত শুরু হতে আরও দুই মিনিট বাকি। মসজিদ বাসা থেকে কাছে হওয়ায় সে পাঞ্জাবী পরে দ্রুত বেরিয়ে গেল৷ হালকা বৃষ্টি হচ্ছে৷ ছোট ছোট এক একটা বৃষ্টির ফোটা তার গালে পড়ছে৷ বৃষ্টির সাথে সে-ও কাঁদছে আর আল্লাহর মাহাত্ম্য নিয়ে ভাবছে। মনে হচ্ছে, তার সব পাপ যেন বৃষ্টির পানির সাথে ঝরে পড়ে যাচ্ছে। 


ফজরের নামায শেষে সে আগের মতোই মসজিদের এক কোনে বসে মাথা নিচু করে কাঁদতে থাকল। দু'হাত তুলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করল। সে বুঝতে পারল, তার এ পাপ তাকে আল্লাহর কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। তাকে এখন থেকে ইবাদত বাড়িয়ে দিয়ে হবে। আল্লাহর কাজে সময় ব্যয় করতে হবে। তাহলে আল্লাহ তাকে গুনাহ থেকে হেফাজত করবেন। 


সূর্য উঠার ১৫ মিনিট পর সে ইশরাকের দু’রাকাত নামায পড়ে বুকভরা অনুপ্রেরণা নিয়ে মসজিদ থেকে বের হল। আল্লাহর তার গুনাহ মাফ করে দেবেন, তাকে পাপ থেকে মুক্তিতে সাহায্য করবেন, এ বিশ্বাস নিয়ে সে জীবনে এগিয়ে যেতে থাকল। 


(সত্য ঘটনা অবলম্বনে। ব্যক্তির পরিচয় গোপন রেখে শেয়ার করা হয়েছে।) 


ঘটনাটি থেকে শিক্ষা

রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “প্রত্যেক আদম সন্তানই পাপী। আর উত্তম পাপী হলো সে ব্যক্তি যে (গুনাহ করে) তওবা করে।” [তিরমিযী ২৪৯৯, ইবনু মাজাহ ৪২৫১ (হাসান)]


পৃথিবীতে এমন কোনো মানুষ নেই যে পাপ করে না বা যার দ্বারা জীবনের কোনো না কোনো সময় পাপ হয়ে যায় না। তবে নবী-রাসুলদের ক্ষেত্রে বিষয়টা ব্যতিক্রম। তারা নিষ্পাপ। আমাদের সাধারণ মানুষদের মধ্যে, কেউ গোপনে পাপ করে, কেউ প্রকাশ্যে, কেউ পাপ করেও আল্লাহর জমিনে দম্ভ করে বেড়ায়, আবার কেউ পাপের অনুশোচনায় হতাশ হয়ে পড়ে। 


আচ্ছা, আমরা যারা পাপ করতে চাই না, পাপ নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা কী? 

পাপ হলে আমাদের আমলনামায় বাম কাঁধের ফেরেশতা সেটা লিপিবদ্ধ করেন। পাপের কারণে আল্লাহ আমাদের ওপর নারাজ হতে পারেন। আমাদের শাস্তি দিতে পারেন। এ বিষয়গুলো আমরা জানি। আবার এটাও জানি যে, পাপ হলে তওবা করতে হয়। তওবা করলে আল্লাহ গুনাহ মাফ করে দেন। শুধু তা-ই না, তওবা করলে আল্লাহ্‌ আগের সব পাপকে, নেকিতে (সাওয়াবে) পরিণত করে দেন। 


আল্লাহ্‌ তা’আলা বলেন,

“কেউ তওবা করলে, ঈমান আনলে এবং সৎকর্ম করলে, আল্লাহ এরূপ লোকদের পাপরাশিকে পুণ্য দ্বারা পরিবর্তিত করে দেবেন। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।) [সূরা ফুরকান: ৭০]”


রসূল ﷺ বলেন, “এক বান্দা গুনাহ্ করল। তারপর সে বলল: হে আমার রব্ব (আল্লাহ্‌)! আমি তো গুনাহ্ করে ফেলেছি; আমাকে ক্ষমা করে দিন। তখন তার রব্ব বলেন: আমার বান্দা কি একথা জেনেছে যে, তার একজন রব্ব রয়েছে; যিনি গুনাহ্ মাফ করেন ও গুনাহর কারণে শাস্তি দেন। আমি আমার বান্দাকে মাফ করে দিলাম। এরপর আল্লাহর ইচ্ছায় কিছুকাল কেটে যায়। এরপর সে আবার আরেকটি গুনাহ করে। তিনি বলেন, তখন সে বলে: ও আমার প্রভু! আমি তো আরেকটি গুনাহ্ করে ফেলেছি; আমাকে মাফ করে দিন। তখন আল্লাহ্ বলেন: আমার বান্দা কি জেনেছে যে, তার একজন রব্ব আছেন; যিনি গুনাহ্ মাফ করেন ও গুনাহর কারণে শাস্তি দেন? আমি আমার বান্দাকে মাফ করে দিলাম। এরকম তিনবার বললেন।” [সহিহ বুখারি: ৭৫০৭]


কিন্তু এরপরও আমরা হতাশ হয়ে যাই। আমরা মুখে বলি আল্লাহ দয়ালু, কিন্তু অন্তর থেকে বিশ্বাস করতে পারি না। এটা মুমিনের কাজ না। আসক্তিকর পাপের হতাশাকে কাজে লাগিয়ে এ জায়গায় শয়তান আমাদের ধোঁকা দেয়। আল্লাহর রহমতের ব্যাপারে নিরাশ করার চেষ্টা করে। আর আল্লাহর রহমতের ব্যাপারে নিরাশ হওয়া অশ্লীল ভিডিও দেখার পাপের চেয়েও অনেক বড় পাপ।


তাই কোনো অবস্থাতেই আমরা আল্লাহর ওপর আশা হারাবো না। আবার আল্লাহ মাফ করে দেবেন, একটু গুনাহ করি। এ চিন্তাও করব না। আপনি সর্বদা পাপ থেকে দূরে থাকার সব চেষ্টাই করে যাবেন। কিন্তু যখনই পাপ হয়ে যাবে তখন তওবা করে আল্লাহর রাস্তায় ফিরে আসবেন। 


আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আমাদের জীবন আমরা কীভাবে কাটাচ্ছি, এটা নিয়ে প্রায়ই চিন্তা করা উচিত। আপনি হয়তো পাপ করছেন না, কিন্তু আপনি আত্মিক প্রশান্তির জন্য তেমন কিছু করছেন না। আপনি ঈমান বৃদ্ধির চেষ্টা করছেন না। দিনের পর দিন চলে যায়, আপনি মসজিদে যান না। মুমিন বান্দাদের সাথে মেশেন না, এই অবস্থাটাই কিন্তু আপনাকে আবার পাপের দিকে নিয়ে যেতে পারে। কাজেই আমরা আমল বাড়ানোর চেষ্টা করব। এমনভাবে জীবন অতিবাহিত করার চেষ্টা করব, যেন আমাদের অন্তর আল্লাহর দিকে ঝুঁকে থাকে। আখিরাতমুখি হয়।

আল্লাহ আমাদের সকল গুনাহ থেকে হেফাজত করুন। এ লেখার ওপর আমাকে এবং যারা পড়েছেন সবাইকে আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

LustManager অশ্লীল কন্টেন্ট-এর আসক্তি নিয়ে কাজ করে। আপনারা বা আপনার পরিচিত যারাই এ ধরণের সমস্যায় ভুগছেন, তাদের LustManager-এ একাউন্ট খুলতে বলতে পারেন।

আর্টিকেলটি ভালো লাগলে আপনার প্রিয়জনদের সাথে আমাদের Newsletter সাবসক্রিপশন এর লিংক শেয়ার করতে পারেন। আগামী শুক্রবার আবার অন্য কোনো টপিক নিয়ে হাজির হব। ইনশা আল্লাহ।

ধৈর্য নিয়ে পড়ার জন্য, জাযাকাল্লাহ।


-Md. Shadek Hossain Minhaz

Mentor, Author, Entrepreneur